১৮৮৮ সালের ৩০শে আগষ্ট‚ জন্মাষ্টমীর রাতে জন্ম তাই দত্ত পরিবার আদর করে ছেলের নাম রেখেছিলেন কানাইলাল। সাবেক চন্দননগরের সর্ষেপাড়ার মোড়ে মামার বাড়িতে জন্ম, তখনও সেখানে ফরাসি আধিপত্য। ছোটবেলা কেটেছে বোম্বাই তে, বাবার চাকরিসূত্রে। কৈশোরে চলে আসেন চন্দননগর। দুপ্লে কলেজে থেকে F.A পাশ করে ভর্তি হন হুগলি মহসীন কলেজে B.A পড়তে। এখানেই বিপ্লবী দলের সংস্পর্শে আসেন আর তারপর তো স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মতো নেমে পড়লেন এক বিশ্বাসঘাতককে সংহার করতে। দিনটি ছিলো ৩১শে আগষ্ট, ঠিক আগের দিন গেছে তাঁর একুশতম জন্মদিন!
সত্যেনকে সাথে নিয়ে ঐদিন যদি না নরেন গোঁসাই কে হত্যা করতেন তাহলে আলিপুর বোমার মামলায় অভিযুক্ত শ্রী অরবিন্দর ফাঁসি কিংবা দ্বীপান্তর ছিল অনিবার্য! পরিবর্তে ১৯০৮ সালের ১০ই নভেম্বর ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে যান কানাইলাল। আলিপুর জেলে অখন্ড বাংলার বুকে ফাঁসি হওয়া প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী। 🛑
হাই পাওয়ারের চশমা পড়তেন কানাই। ফাঁসির আগের দিন জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন দাদা আশুতোষ। বলেছিলেন, ‘তোর চশমাটা দে, একটা কিছু তো স্মৃতি হিসেবে রাখি।’
কানাই বলেছিলেন, ‘দাদা, চশমাটা আমি এখন দিতে পারব না। চোখে হাইপাওয়ার, ফাঁসির মঞ্চে উঠতে গিয়ে যদি হোঁচট খাই এরা ভাববে বাঙালির ছেলে মৃত্যুর আগে ভয় পাচ্ছে। বরং আমার মৃত্যুর পরে নিও। পরবর্তী কালে এই বড়দাদা তাঁর নাতনি শর্বরী বসুকে বলেছিলেন, গলায় দড়ি পরিয়ে দেওয়ার পর ভাই একজন পুলিশকে ডেকে বলে, মৃত্যুর পর আমার চশমাটা বড়দাদাকে দিয়ে দিও। সেই চশমা এখন কানাইলাল বিদ্যামন্দিরে রাখা আছে।
১০ই নভেম্বর ১৯০৮…..
নো নো, ডোন্ট ব্ল্যাকেন মাই ফেস, প্লীজ!
ফাঁসির মঞ্চে উঠে আসতে আসতে মাথা থেকে গলা পর্যন্ত ঢাকবার কালো কাপড় হাতে ধরে রাখা লোকটির দিকে চেয়ে অনুরোধের সঙ্গে একটা ভুবনভোলানো হাসি ছুঁড়ে দেয় কানাইলাল দত্ত। সদ্য স্নান সেরে এসে তাকে আরও নির্মল, আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে কি?
মঞ্চের পিছনে দাঁড়িয়ে এ-হেন শেষ অনুরোধ শুনে কিছুটা বিব্রতই হয় ইংরেজ জেলার ইথান প্রাইস। নাতিদীর্ঘ কর্মজীবনে এর আগে যে ফাঁসি দেখেনি সে, তেমনটা নয়। তবে এবারকার সবকিছুই যেন নতুন ঠেকছে, তার একটা প্রমাণ সে অনুভব করছে নিজের স্নায়ুতে। কমিশনার হ্যালিডে ইঙ্গিত করেন, আসামীর ইচ্ছাকে মান্যতা দেওয়ার।
ফাঁসুড়ে তার হাতের দড়িটা মুখ-না-ঢাকা কানাইলালের গলায় দিতে এগিয়ে আসে।
ইট ডাজন্ট ফীল রাইট!
হ্যালিডে চমকে তাকান। ম্যানিলা রজ্জুটা কেমন করে যেন মাথা দিয়ে ঠিকঠাক গলানো হয়নি। সহাস্য আসামী ডান হাতের দুই আঙুলে সেটাকেই ঠিক করে নিজের গলায় পরে নিচ্ছে এবার!
মিস্টার প্রাইস, য়ু দেয়ার?
পরিচিত হাসির সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা ভেসে আসতে মাথা আর সোজা রাখতে পারে না ইথান।
য়ু ওয়ন্টেড টু সী মি, রাইট? হাউ ডু আই লুক নাউ?
লিভার টানার চেনা শব্দটা ফুরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ইথান প্রাইস এক মনে ভাববার চেষ্টা করছিল, ওই কালো কাপড়টা দিয়ে তারই মাথা-মুখ ঢেকে দেওয়া হল না কেন!
কুয়ো থেকে বের করা দেহটার দিকে না তাকিয়েই হাঁটা দিলেন জেল অফিসের দিকে……। পরে দাদা আশুতোষকে দেহ নিতে আনার সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমাদের দেশে এরকম ছেলে আর ক’টা আছে ?
জেলগেট দিয়ে দাদা আশুতোষ দত্ত ভাইয়ের মৃতদেহ নিয়ে বাইরে এসে দেখেন অত সকালেও সেখানে বহু মানুষ হাজির । দেহ তারাই কাঁধে তুলে নিল । শবযাত্রা যত এগোতে লাগলো তত বাড়তে লাগলো ভীড় । সে দিন তাঁর শবদেহ নিয়ে কলকাতা শহরের বুকে এক জনপ্লাবনের সাক্ষী থেকেছে পুলিশ ও প্রশাসন। লক্ষ লক্ষ মানুষ…..তারা একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে এক বারের জন্য হলেও শববাহী খাটটি ছুঁতে চায়। সর্বত্র ‘জয় কানাই’ ধ্বনিতে আন্দোলিত। শহীদের শেষ যাত্রায় এতো জনসমাগম আগে কোনদিন দেখেনি কলকাতা ।
কেওড়াতলা শ্মশানে দাহকার্যের পর কানাইলালের ‘চিতাভস্ম’ কেনার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হয়। আধ ছটাক চিতাভস্মের জন্য কোনও কোনও অত্যুৎসাহী সেই আমলে পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন !
কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্মচারী এফ সি ড্যালি পরে বলেছিলেন “কানাইলাল দত্তের চিতাভস্ম বলে শহরে ঐদিন যা বিক্রি হয়েছিল, অনুমান করা হচ্ছে তা চিতাভস্মের প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে অন্তত পঞ্চাশ গুণ বেশি!”
কিন্তু আজ প্রশ্ন উঠছে, মৃত্যুঞ্জয়ী এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্মৃতি রক্ষায় স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে আমরা কি করেছি ..?🍁
চন্দননগরের জিটি রোডের ওপর সেই বাড়িটির এখন ভগ্নপ্রায় দশা, খসে পড়ছে পলেস্তারা। তবুও
কানাইলালের জন্মভিটে বললে সকলে একবাক্যে খয়েরি রংয়ের বাড়িটি দেখিয়ে দেন। এখন সেখানে কানাইলালের মা ব্রজেশ্বরী দেবীর বংশধরেরা থাকেন। বাড়িটির লাগোয়া রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে কানাইলাল অ্যাভিনিউ। একেবারে সামনের একটি ঘরে রয়েছে বিপ্লবীর আবক্ষমূর্তি। মূর্তির পাশে জমেছে ঝুল। আর আছে তাঁর নামাঙ্কিত একটি স্কুল….. ব্যাস !