অন্যরকম সাধু
মধ্যপ্রদেশে সাৎনা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। বেঞ্চে বসে আছি। একজন, গেরুয়া জামা ও সাদা ধুতি পরা, এসে বসলেন পাশে। জিজ্ঞেস করলাম “কোন আশ্রমের সাধু আপনি?” উত্তর — সাধু নই। আমি তাকিয়ে আছি দেখে হেসে বললেন — অসাধুও নই। বিস্মিত হলাম, কৌতূহলীও। বুঝলাম, ট্রেন না আসা অবধি এনার সাথে গল্প করা যাবে।
শুরু করলাম আলাপ।
● সাধু নন কিন্তু এই গেরুয়া কাপড় …?
¤ একজন দিলেন। আগেরটা ছিঁড়ে গিয়েছিল।
● ঘর ছাড়লেন কেন ?
¤ কি করব ঘরে? বিয়ে, সংসার? নিজেকে সামলাতে পারি না তো বৌকে কিভাবে সামলাবো? নিজেই মানুষ হলাম না তো ছেলেমেয়েকে কিভাবে মানুষ করব?
● মজার মানুষ আপনি! এজন্যই বুঝি ঈশ্বরের সন্ধানে পথে বেরিয়ে পড়লেন?
¤ ঈশ্বর? মনগড়া ধারণার পেছনে ছুটে লাভ কি?
● ঈশ্বর কল্পনা? সত্য নয়?
¤ মীরা-চৈতন্য-কবীরের কাছে সত্য, কারণ তারা ঈশ্বরকে অনুভব করেছিলেন। কিন্তু আমি তা নই। তাদের কথা পড়ে বা শুনে আমি একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছি এ-বিষয়ে। আমার ঈশ্বর, ব্রহ্ম, নির্বাণ, সবই ধারণা, কল্পনা। তাই ঈশ্বরকে খুঁজি না আমি। কল্পনার পেছনে ছুটে কি করব?
● ইন্টারেস্টিং। তাহলে ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে কোন্ সাধনা করছেন?
¤ সাধনা করব কেন? অন্য কাজের মতো সাধনারও একটা উদ্দেশ্য থাকে, ইচ্ছা থাকে। কিন্তু আমার তো কোনো ইচ্ছা নেই?
● তার মানে আপনি নির্বাসনা অবস্থায় পৌঁছে গেছেন?
¤ ইচ্ছা রেখে কি করব বলুন? আমি কিছূ চাইলেই কি পাব? আমার ইচ্ছামতো জগৎ চলে না, মানুষেরাও কাজ করে না। তাই ইচ্ছা ত্যাগ করেছি।
● এতক্ষণে বুঝলাম আপনি এক সন্ন্যাসী। তবে অন্যরকম। এজন্যই সব ত্যাগ করে আজ সাধু।
¤ ত্যাগ? আমার ছিল কী যে ত্যাগ করব? বাড়িটা তো বাবার সম্পত্তি ছিল। তিনি একটা ঘর দিয়েছিলেন থাকার জন্য, আর মা খেতে দিতেন। আমি আগেও ভিখারি ছিলাম, এখনও তাই আছি।
● আপনার কি তবে কোন সাধন-পথ নেই?
¤ কেন সাধনা করব, বলুন? কী পাওয়ার জন্য?
● তা ঠিক। নির্বাসনা ব্যক্তির আবার সাধনা কি? কিন্তু শুনেছি যে নির্বাসনা হলে নিজের প্রকৃত সত্তার অনুভব হয়।
¤ কি জনি! তবে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। হঠাৎ দেখলাম এই শরীরটা আলাদা এক সত্তা। নিজের কাজ নিজেই করে চলেছে আমার সাহায্য ছাড়াই। নিজেই শ্বাস নিচ্ছে, খাবার হজম করছে, রক্ত চলাচল করছে, চুল-নখ বাড়ছে, ক্লান্ত হলে ঘুমোচ্ছে…। শরীর নিজেই কাজ করে যাচ্ছে, আমার অনুমতি ছাড়াই। রেগে গিয়ে শরীর-ব্যাটাকে নির্বাসন দিলাম — তোর যা ইচ্ছা কর, আমাকে ডাকবি না। পরে দেখলাম মন-ব্যাটাও আমার কথা শুনতে চায় না। আমি এদিকে যাব, তো মন ওদিকে যেতে চায়। বুঝলাম, শরীর আর মন মিলে আমার বিরুদ্ধে ইউনিয়ন তৈরি করেছে। খুব ধমক দিলাম। শুনতেই চায় না আমার কথা। ঘন-ঘন শ্লোগান দিত “আমাদের দাবী মানতে হবে।”
● আচ্ছা, শরীর-মনের শ্লোগান যে শুনছে সেই আপনি কেমন সত্তা? আপনার সেই চেহারাটা কেমন?
¤ জানি না। কখনো মনে হয় সেই সত্তাটা আছে অথচ নেই। অর্থাত ভুত নেই কিন্তু ভূতের হাসি চলছে।
● আপনার অতীত জীবনের কথা শুনতে চাই। কোথায় থাকতেন, কিভাবে এই পথে এলেন?
¤ ঘুম থেকে উঠে লোকেরা মুখ ধোয়, চা খায়, নাকি রাতে কি স্বপ্ন দেখেছিল এটা নিয়ে চিন্তা করে? অতীতে পড়ে থাকা মানে চিন্তার বন্ধনে থাকা। পথের বাধা।
● কিন্তু অতীতই তো বর্তমানের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে নিয়ে যায়!
¤ ভবিষ্যত? আজ এই মুহুর্তে হার্ট-এটাক হয়ে মৃত্যু হতে পারে। অতীত-ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা এক ছেলেমানুষী খেলা।
● কিন্তু এই যে জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়, এটাও তো অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতেই?
¤জগৎ? কোন জগৎ? জগৎ আছে বলে আপনি দেখছেন, এ-কথা ভুল। সত্য হল, আপনি দেখছেন বলেই জগৎ রয়েছে।
● এতক্ষণে বোঝা গেল আপনি বেদান্তবাদী সন্ন্যাসী। নেতি-নেতি বিচারের সাধক। কিন্তু বাবা, এ ভীষণ হাই-ডোজের বেদান্ত। অজাতবাদের কাছাকাছি। একটু নেমে এলে সাধারণ সাধকেরা খুবই উপকৃত হত আপনার কাছে এসে।
¤ কোন মানুষ? কাদের কথা বলছেন আপনি? জীব-জগৎ বলে কিছু নেই। সময় অর্থহীন। কে বলতে পারে, কি আছে?